প্রতিনিধি ১৫ অক্টোবর ২০২০ , ১১:৫৮:০২ প্রিন্ট সংস্করণ
তেরো বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিলেন, সম্বল ছিল ষোলোটি টাকা। যখনই থিতু হয়েছেন, আঘাত এসেছে, মালামাল সহ পুড়ে গেছে গোটা দোকান। তিনি হাল ছাড়েননি, শেষমেশ হেসেছেন বিজয়ীর হাসি, নিজেকে পরিণত করেছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের একজন হিসেবে…
বাংলাদেশে ‘উদ্যোক্তা’ হওয়ার ঝক্কি খুব কম মানুষই নিতে চায়। কারণ এখানে লাগাতার হেরে যাওয়ার ভয় থাকে। গোটা সংগ্রামটাই তো খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে। একটুখানি ভুলচুক হলেই তাই পপাত ধরনীতল। মানুষ তাই ভয় পায়। যেটা খুব বেশি অমূলকও না। তাছাড়া বাংলাদেশের যে আবহাওয়া; বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই বিসিএস-বিসিএস বলে এক বিকট রব শুরু হয়। এ দেশের পরিবেশ ঠিক উদ্যোক্তা-বান্ধবও নয় তাই। তবুও এ দেশ থেকে নামকরা অনেক উদ্যোক্তাই এসেছেন। হয়তো বিশ্বমঞ্চে কাঁপিয়ে দেয়ার মতন উদ্যোক্তা আমরা পাই নি, তবে এই প্রতিকূল পরিবেশে দাঁড়িয়ে এ দেশের জলবায়ুতে যাদের আমরা পেয়েছি, তারাও একেবারে ফেলনা নন। এদের মধ্য থেকেই একজনের নাম বলবো আজ।
তাঁর নাম শেখ আকিজ উদ্দিন। তাঁর নামে একটি খুব বিখ্যাত পন্য আছে। হ্যাঁ, আকিজ বিড়ির কথা বলছিলাম। বাংলাদেশের প্রায় সবাই এই বিড়ি চেনে। এটুকু পড়ে অনেকে আবার নাক সিঁটকে চলে যেতে পারেন যে, বিড়ির ব্যবসায়ীর গল্প তাদের কাছে বলতে এসেছি। তাদের উদ্দেশ্যে একটাই কথা বলার, এই মানুষটির পুরো গল্প জানলে যেকোনো পাঠকের ভেতর থেকে নিখাদ শ্রদ্ধা ও সম্মান যে আসবে… সেটা হলফ করে বলতে পারি।
তার জন্ম খুলনায়, ১৯২৯ সালে। দরিদ্র পরিবার জন্ম। বাবা কৃষিকাজ করতেন। বাবার পাশাপাশি আকিজও জমিতে উৎপন্ন পন্য, বাবার সাথে গিয়ে হাটে বিক্রি করে আসতেন। যে টাকাপয়সা পাওয়া যেতো এসব পন্য বিক্রি করে, তাতে খুব কায়ক্লেশে জীবন চলতো তাদের। পরিবার যেহেতু ভালো চলছিলো না, ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় একদিন ঘর ছাড়েন আকিজ। বাড়ি থেকে মাত্র ষোলো টাকা সম্বল করে চলে আসেন কলকাতায়। শিয়ালদহ স্টেশনে থাকতেন, সারাদিনে একবার মাত্র ছয় পয়সার ছাতু খেতেন আর কাজ খুঁজতে থাকতেন। কিন্তু কোথাও কাজ খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
এরপর শুনলেন, কমলালেবুর ব্যবসা করে বেশ ভালো উপার্জন করা সম্ভব। আকিজ তখন পাইকারি দরে কমলা কিনে সেগুলোকে ফেরি করে বিক্রি করা শুরু করলেন। হাওড়া ব্রিজের আশেপাশের এলাকা ছিলো তার রুট৷ পুলিশকে প্রতিদিন দুই টাকা ঘুষও দিতে হতো, তার এই কাজের জন্যে। এভাবে কমলালেবু বিক্রি করে বেশ কিছু উপার্জনও হলো তার৷ ব্যবসায় সফলতা অর্জনের মূলকথা, এক ব্যবসায় বেশিদিন থাকা যাবে না। আকিজও এই মূলকথাকে আপ্তবাক্য মেনে তাই ফলের ব্যবসা ছেড়ে দিলেন। তাছাড়া কমলার সীজনও শেষ হয়ে আসছিলো। এবার তিনি অন্য ব্যবসা ধরলেন। ভ্রাম্যমাণ মুদির দোকানের ব্যবসা। কলকাতায় তখন ভ্যানের উপর ভ্রাম্যমাণ মুদি দোকানের বেশ জনপ্রিয়তা। আকিজও সেরকম এক দোকান দিয়ে বসলেন।
সমস্যা হলো, এই ব্যবসায় ভালো করতে হলে গ্রাহককে আকৃষ্ট করার টেকনিক জানতে হবে। আকিজ সেটা জানতেন না। তবে আশেপাশের দোকানদারদের দেখে সেই টেকনিক শিখে নিতেও খুব বেশি সময় লাগলো না আকিজের। টেকনিক আর কিছুই না, সুর করে হিন্দি ছড়া বলে খদ্দেরকে টানতে হবে দোকানে। হিন্দি ভাষার এই ছড়াগুলো শিখে নিয়ে আকিজ নিজেও সুর করে কবিতা বলে ব্যবসা করতে লাগলেন।
রমরমা ব্যবসা হলো কিছুদিন। কিন্তু বেশিদিন হলো না৷ পুলিশ এসে একদিন মারধোর করে রাস্তা থেকে উঠিয়ে দিলো আকিজ ও তার গাড়িকে। জেলে তিন দিন আটকে রাখলো, পাঁচ টাকা জরিমানাও করলো। এই অহেতুক অত্যাচারে রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে আকিজ এই ব্যবসা ছেড়ে দিলেন। এরপর পেশোয়ারের এক লোকের সাথে পরিচিত হয়ে ফল ব্যবসা শুরু করলেন আবার। দুই বছর ফলের ব্যবসা করলেন। বেশ লাভও হলো। হাতে চলে এলো দশ হাজার টাকা (সে আমলে দশ হাজার টাকা নেহায়েত কম নয়)।
সেই টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু হয়ে গিয়েছে। বাড়ি ফেরাই তখন প্রাসঙ্গিক ছিলো। বাড়ি ফেরার কয়েকদিনের মধ্যেই তার বাবা ও মা মারা যান। আকিজ তখন নিজ গ্রামের এক মেয়েকে বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করেন। বিয়ের পরে বেশিদিন চুপ করে বসে থাকতে তিনি পারেন না। কিছু একটা করার চেষ্টা করেন। পেয়ে যান বিড়ির ব্যবসা শুরু করার আইডিয়া। তাদের গ্রামে তখন চলতো বিধু বিড়ি। সেই বিড়ি কোম্পানির যে মালিক, তার ছেলে ছিলো আকিজের বন্ধু। তার থেকেই এই ব্যবসার আইডিয়া পেয়ে আকিজ শুরু করেন ‘আকিজ বিড়ি’র ব্যবসা। বেশ রমরমিয়ে যাচ্ছিলো সব। ধাক্কা খেলেন আবারও। তার আকিজ বিড়ির কারখানায় আগুন লেগে সব পুড়ে গেলো। মরে যেতে পারতেন তিনিও। আশ্চর্যজনকভাবে তিনি বেঁচে গেলেন। তবে দোকানের ষাট হাজার টাকার মালপত্র ও নগদ কয়েক হাজার টাকা, কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে স্রেফ ‘ছাই হয়ে গেলো। আকিজ আবার পথে বসে পড়লেন।
আকিজ আবার শুরু করেন ব্যবসা। বিড়ি, ধান, চাল, গুড়, ডাল, পাট এর ব্যবসা করে, অমানুষিক খেটে তিনি আবার টাকাপয়সা উপার্জন করা শুরু করেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ততদিনে ‘আকিজ বিড়ি’ এক ব্রান্ড হয়ে গিয়েছে। এরপর শেখ আজিজ জীবদ্দশায় প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন বিশটিরও মত প্রতিষ্ঠান। যার প্রতিটিই সুনাম কুড়িয়েছে, হয়েছে বিখ্যাত। ‘আকিজ বিড়ি’কে জাপান টোব্যাকো তো ১.৫ বিলিয়ন ডলারে কিনেও নিয়েছে সম্প্রতি।
শেখ আকিজ উদ্দিন বরাবরই ছিলেন কর্মঠ, বিনয়ী। এতবার ধাক্কা খেয়েছেন, তবু বসে থাকেন নি, আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন, আবার চেষ্টা করেছেন। এভাবে করতে করতেই ষোলো টাকা সম্বল নিয়ে কলকাতায় আসা ছেলেটির অর্থসম্পদ দাঁড়িয়েছে হাজার কোটি টাকায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তিনি যথেষ্ট মানবিক একজন মানুষও। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বড় অঙ্কের অর্থ সাহায্য করা, স্কুল কলেজ স্থাপন, ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা… মানুষের কল্যানের জন্যে জীবদ্দশায় তিনি তার সামর্থ্য অনুযায়ী গড়েছেন অনেক প্রতিষ্ঠানই। সেগুলো তার মৃত্যুর পরেও এখনো মানুষকে দিয়ে যাচ্ছে সেবা। এভাবেই মৃত্যুর পরেও প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন তিনি। আশা করি, তিনি তার কাজের পরিধি ও সংগ্রামের গল্পে সামনেও অনুপ্রাণিত করবেন অজস্র হতাশাগ্রস্ত ও হতোদ্যম মানুষকে।
এভাবেই একজন শেখ আজিজ উদ্দিন আমাদের জন্যে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার এক নিখাদ উৎস হয়ে থাকবেন বরাবরই।