প্রতিনিধি ১৭ নভেম্বর ২০২২ , ১১:১৩:৪০ প্রিন্ট সংস্করণ
“অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করে, যারা প্রতিবাদ করে, তারাই ইতিহাস রচনা করে” কথাগুলো সত্য হলেও আমরা ধরে নেই, কথার কথা, সবাই তো বলে, এ আর নতুন কি? কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি স্পষ্ট হবে। গণমানুষের অধিকার নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে ইতিহাস রচনা করেছেন আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা ড. মার্টিন লুথার কিং। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ছিল আবেগতাড়িত জনতার ওপর নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত রূপ। আর ওই নৃশংসতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে চরম ধিক্কার ও ঘৃণাবোধ থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নাইটহুড’ (স্যার টাইটেল) উপাধি ত্যাগ করেন, যা ভারতীয় স্বাধীনতার ইতিহাসে প্রতিবাদ জানাবার এক ঐতিহাসিক দলিল হয়ে আছে। ধর্মের গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও অন্ধত্বের বিপক্ষে কথা বলেছেন আর ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে তাদের বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদ ও লড়াই করেছেন মহাত্মা সাধক বাউল সম্রাট লালন শাহ।
আফ্রিকার গণমানুষের লড়াইয়ের জন্য যিনি তাঁর পুরো জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে যিনি লড়াই করেছিলেন, সারাজীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন কালো এবং সাদা চামড়ার বৈষম্য দূর করতে। লোকে তাকে ভালবেসে ডাকে “মাদিবা”। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো যার সাথে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন- ” আমি হিমালয় দেখিনি। কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজীবন আপোষহীন ছিলেন বাঙালী জাতি রাষ্ট্রের ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতার মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবিশ্বাস্য সাহসী ও বীরত্বের অপরিসীম একটি পূর্নাঙ্গ ইতিহাস হল, বঙ্গবন্ধু। এভাবেই ইতিহাস বারে বারে সাক্ষ্য দেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা।
কিন্তু আজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে নৈতিক প্রতিবাদ ও লড়াই তেমন নেই বলেই মাথাপিছু আয় বাড়লেও সমাজে অস্থিরতা কমেনি, নেই চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে সামঞ্জস্যতা, আকাশ সম প্রত্যাশা যা সামর্থের বাইরে (অবৈধভাবে হলেও তা পেতেই হবে), শুধুই নিজের অনুচিত সুবিধা হাসিলের অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
আর হবে নাই বা কেন? কেউ পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করলে আমরা বলি আরো ভালো রেজাল্ট কর, কারো কোন বৈষয়িক প্রাপ্তি হলে আমরা বলি আরো বড় প্রাপ্তির জন্য চেষ্টা করো, আরো বড় কিছু বৈষয়িক পাওয়ার লড়াই কর। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে বলি বিসিএস দিয়ে ফরেন সার্ভিস, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, ট্যাক্স ইত্যাদিসব ক্যাডারে যোগ দিয়ে বড় অফিসার হও । সরকারী চাকুরীতে প্রতি বছর হাজার হাজার উচ্চশিক্ষিত মানুষ ক্যাডার অফিসার হিসেবে যুক্ত হচ্ছে। তারপরও প্রায় সব ক্ষেত্রেই নৈতিক তথা সামাজিক অবক্ষয় লক্ষনীয়, কেন? অবশ্য অভিভাবকরা, আমরাও এখন তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে বলিনা যে সবার আগে আমার সন্তান হিসেবে ভালো মানুষ হও। আমরা এখন শুধুই ক্ষমতা ও অর্থের পূজারী। সন্তানকে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ বা উচ্চ পদস্থ ক্ষমতাসীন কর্মকর্তা বানাতে পারলে জীবন সার্থক বলে মনে করি। কিছুদিন আগে আমার কজন পরিচিত বন্ধু মিলে একটা দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ এক বন্ধু বলল তাকে উঠতে হবে। বললাম, কেন? সে বলল বিসিএস কাস্টমস কর্মকর্তা মিস্টার এক্স আসছেন তাকে রিসিভ করতে হবে এবং তাকে সঙ্গ দিতে হবে। তখন আমার মনে হলো একজন শিক্ষক এর চেয়েও সমাজের বেশী প্রয়োজন একজন বিসিএস কাস্টমস কর্মকর্তা। একজন শিক্ষকের না আছে অর্থ না আছে ক্ষমতা, কাজেই তাকে সঙ্গ দিয়ে তেমন কোন সিদ্ধি লাভ করা যায় না। যাহোক হয়তোবা বন্ধুটির মিঃ এক্স এর কাছে আরও কোন ব্যক্তিগত সংযোগ থাকতে পারে। আজকে সমাজে অনেক উচ্চশিক্ষিত বিসিএস ক্যাডার, নন-ক্যাডার, শিক্ষক, কিন্তু এতো এতো শিক্ষিত মানুষ মিলেও সমাজের অস্থিরতা কে আমরা দূর করতে পারছি না। শিক্ষা আছে, তবে প্রকৃত শিক্ষা, নৈতিকতার শিক্ষা, মানবতার শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা হয়তো নেই। আজকের সমাজে অস্থিরতার কারণ হল অতিরিক্ত লোভ, স্বল্প শ্রম অথবা শ্রম না দিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের তাড়না, আত্ম অহংকার, বিবেকতারিত না হয়ে রিপুরতারিত হওয়া, আত্মকেন্দ্রিকতা ইত্যাদি। চারপাশ বিষাক্ত করে তার ঠিক মাঝখানে নিজেকে সুস্থ রাখার অলীক স্বপ্নে বিভোর আমরা। আমাদের পঠন, পাঠন-শিখন আমাদের লোভকে সংবরণ করাতে পারছে না, আমাদের আত্মঅহংকারকে নিয়ন্ত্রণ করাতে পারছে না, আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতাকে দূর করাতে পারছে না, পারছেনা আমাদের চেতনাকে, আমাদের মননশীলতাকে জাগ্রত করাতে।
এইতো সেদিন একটা অনুষ্ঠানে গেলাম, সেখানে কৃতি শিক্ষার্থীদের গোল্ড মেডেল প্রদান করা হলো। বক্তাগণ তাঁদের বক্তব্যে বললেন, তোমাদের এই গোল্ড মেডেল প্রাপ্তি তোমাদেরকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। তোমরা এখানেই থেমে থেকো না, আরো বড় বড় পুরস্কার তুলে নেয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও। এই যে মোটিভেশন এর প্রয়োজন অবশ্যই আছে। তবে আমার মনে হয় এর চেয়েও এখন বেশি প্রয়োজন মানুষ হবার প্রতিযোগিতার কথা, মানবিক হবার প্রতিযোগিতার কথা, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নৈতিক মূল্যবোধে শক্তিশালী হবার প্রতিযোগিতার কথা বলা। আজকে বেশি প্রয়োজন ন্যায়পরায়ণতা, সততা, শিষ্টাচার, শাসক বা শোষক নয় সেবা করার মানসিকতা, উত্তম ব্যবহার, সহনশীলতা, সহানুভূতি এবং সমানুভূতি অর্জনের প্রতিযোগিতার কথা বলা। সেটা না হলে মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরি করা কঠিন। এক সময় আমরা বৈষয়িক এসব প্রতিযোগিতায় অনেক কিছু পাবো হয়তোবা কিন্তু কোনটাই টেকসই হবে না, যদি না নৈতিকভাবে উন্নত সমৃদ্ধ হতে পারি। জাপান পৃথিবীর একটি উন্নত দেশ। সেখানে যাবার সুযোগ যাদের হয়েছে তারা দেখেছেন জাপানিরা কতটা সৎ এবং নৈতিকভাবে শক্তিশালী। ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের কতটুকু আছে জানিনা, তবে অনৈতিক কোন স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা তারা কখনই করে না। কাউকে ঠকানোর চিন্তা করে না। প্রি-প্রাইমারি স্কুল থেকেই সেখানে সততা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, অপরাধ করলে বিনয়ের সাথে ক্ষমা চাওয়া, আন্তরিকতা দিয়ে যে কোন দায়িত্ব সম্পন্ন করা, লোভ সংবরণ করা ইত্যাদি হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হয়। সেজন্য জাপানি যে কোনো পণ্য বা সেবা বিশ্বের সকলের কাছে নির্ভরতায় অদ্বিতীয়।
বর্তমানে দেশে শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও সমাজে অনেক। এমনকি আমাদের অনেকে কানাডা, জাপানসহ পৃথিবীর উন্নত দেশ থেকে নৈতিকতার উদাহরণ স্বচোক্ষে দেখে এসেছি। কিন্তু নিজের মাটিতে এসে এসকল শিক্ষার প্রয়োগ কমে যায়। কাজেই উচ্চশিক্ষায় অনেক শিক্ষিত হয়েও ভালো ও মন্দের পার্থক্য করে কোনটি গ্রহণীয় বা বর্জনীয় এ ধরনের মানুষের সংখ্যা নেহাত কম। ভালো কে সহজ ভাবে ভালো বলতে পারা এবং মন্দ ও অসত্যকে সাবলীলভাবে মন্দ বলতে পারা মানুষের সংখ্যা কিঞ্চিত। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে পারে এ ধরনের মানুষের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অবশ্য নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব যখন বুঝতে পারি না অর্থাৎ স্কুলের ক্লাস সিক্স বা সেভেনে তখন এই শিক্ষা গ্রহণ করি, কিন্তু যখন বুঝতে পারি অর্থাৎ গ্রাজুয়েট ও মাস্টার্স লেভেলে, তখন পড়ি না বা পড়ার সুযোগ থাকে না। সততার সংগ আমরা পছন্দ করি না, মিথ্যার সাথে বন্ধুত্বে আমাদের সময় বেশ ভালো কাটে। বিপদে পড়লে সত্য-মিথ্যা একসঙ্গে করে ককটেল বানিয়ে ফেলতে পারি। এই হল আমাদের তথাকথিত শিক্ষার ফল। অবশ্য আমরা মাঝে মাঝে সস্তা সহানুভূতি দেখানোর চেষ্টা করলেও সমানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করি না।মাঝে মাঝে সস্তা মানবিক হবার চেষ্টা করলেও নিজেকে পরিপূর্ণ মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হবার চেষ্টা করি না। উপরে ভালো মানুষ সাজি কিন্তু ভেতরের আসল চেহারা অন্যরকম। কথায় কথায় সত্য প্রমাণ করবার সাক্ষ্য হাজির করার নানা অঙ্গ ভঙ্গি দেখাই বা ফন্দি ফিকির করার চেষ্টা করি, কিন্তু আদৌ সত্য প্রমাণ করতে চাই না বা এর ধারের কাছেও যেতে চাই না। এসব করি লোক দেখানো, ভালো মানুষ হবার ভান করি। কাজেই যে প্রথা বা প্রতিযোগিতা ভালো-মন্দের পার্থক্য করার শিক্ষা দিতে পারেনা, সত্যকে সত্য বলার ও মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সৎ সাহস যোগাতে পারে না, সেই প্রথা বা প্রতিযোগিতা দিয়ে মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরি করা সম্ভব নয়। কাজেই বৈষয়িক শিক্ষা বা প্রতিযোগিতাকে নৈতিক শিক্ষা ও প্রতিযোগিতায় পরিণত করতে পারলেই এ দিয়ে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকানো সম্ভব হবে। তা নাহলে শুধুই ঠুনকো বৈষয়িক কিছু প্রাপ্তিই হবে আমাদের সম্বল। আসুন টেকসই পরবর্তী প্রজন্ম, সমাজ ও দেশ বিনির্মাণে এসবের দিকে একটু মনোযোগ দেই।
ড. এ. কে. এম. লুৎফর রহমান
অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।