• বাতায়ন

    শীতার্তদের পাশে দাঁড়ান

      প্রতিনিধি ৭ জানুয়ারি ২০২৩ , ১০:৫০:০৬ প্রিন্ট সংস্করণ

     

    শীতের তীব্রতায় চারপাশের পরিবেশ কাঁপতে শুরু করেছে। দিন যত যাচ্ছে, শীতের প্রকোপও তত বাড়ছে।

     

    ঋতুর আবর্তনে শীত আসবে, এটাই স্বাভাবিক। এর সঙ্গে খাপ খেয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। তবে তীব্র শীতে গরিব ও দুস্থ মানুষের বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়।

     

    শীতে শিশু ও বৃদ্ধরা অন্যদের চেয়ে একটু বেশি কষ্টে থাকে। তাই যারা সামর্থ্যবান, তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত-শীতে পরিবারের সবাই যেমন ভালো থাকব, ঠিক তেমনই অন্যদের পাশেও আমরা সাধ্যমতো দাঁড়াব।

     

    আমরা দেখি, শীতের শুরুতেই গরম কাপড় কেনার ধুম পড়ে যায়। কেউ নতুন, কেউবা পুরোনো কাপড় কিনে সামর্থ্য অনুযায়ী। শীতে কর্মজীবী মানুষ খুব কষ্ট পায়। কুয়াশা আর ঠান্ডার মধ্যেও জীবিকার সন্ধানে সবকিছু অতিক্রম করে তাদের কাজে নামতে হয়। কুয়াশার চাদরে যখন প্রকৃতি ঢেকে থাকে, তখন অন্যদের মতো তাদেরও ইচ্ছা করে লেপের নিচে শুয়ে থাকতে। কিন্তু দুমুঠো ভাতের জন্য তা সম্ভব হয় না।

     

    একদিন কাজে না গেলে বা কাজ না পেলে তাদের পরিবারে খাদ্য সংগ্রহ হয় না। দিনের কাজ করে বাড়িতে ফিরলেই কেবল পরিবারের জন্য দুমুঠো ভাত সংগ্রহ হয়। কিন্তু এত শীতেও তারা বাইরে বের হবে, এটা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়।

     

    শীতের তীব্রতা বেড়েছে। সকালবেলা কুয়াশার চাদরে প্রকৃতি ঢেকে যাচ্ছে। নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টসহ শীতকালীন বিভিন্ন রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। হাসপাতালে বৃদ্ধ আর শিশু রোগীদের ভিড়।

     

    রোগীর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। বয়স্কদের তুলনায় শিশু ও বৃদ্ধের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা কম। সবচেয়ে কষ্টে আছে ফুটপাত ও বস্তির শিশুরা। যারা অন্য সময় দৌড়ে বেড়ায়, খেলাধুলা করে বেড়ায়, খালি গায়ে বিভিন্ন কাজে সর্বদা ব্যস্ত থাকে, তারা এখন শীতের কাছে হার মেনেছে। তাদের গায়ে নেই কোনো গরম কাপড়। আবার কারও একটা জামাও জোটে না। বস্তির মধ্যেই তাদের থাকতে হচ্ছে। সেখানে প্রায় অলস দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের। এসব শিশুর কথা কেউ তেমন ভাবে না। যদিও কোনো কোনো সংগঠন, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান শীতবস্ত্র বিতরণ করে থাকে; তবে তা করা হয় মূলত শীত চলে আসার পর। এতে খুব অল্পসংখ্যক শীতার্তকে বস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব হয়। অধিকাংশ শিশুই শীতের কাপড় থেকে বঞ্চিত হয়।

     

    পৃথিবীতে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে প্রাণিকুলের শ্রেষ্ঠ করে। কিন্তু এ মানুষ যখন নিজের জন্যই সবকিছু করতে ব্যস্ত থাকে, আশপাশের দরিদ্রদের জন্য কিছু করে না. তখন সে তার শ্রেষ্ঠত্ব হারায়। আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছে, যারা বছর বছর নতুন করে শীতের কাপড় ক্রয় করে। কিন্তু পাশের বাড়ির কোনো বৃদ্ধ বা শিশু শীতে কাঁপছে-এটা তারা দেখেও দেখে না। অথচ তাদের একটু সহানুভূতিতে, একটু সচেতনতায় শীতার্তরা উপকৃত হতে পারে।

     

    তীব্র শীতে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুরু হয় শীতের ছুটি, তখন কর্মজীবী মানুষের কোনো ছুটি নেই। শিশুশ্রমিকরাও কাটাতে পারে না কোনো ছুটি। ঋতুর সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রুটিন পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু প্রতিদিন যাদের শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে হয়, তাদের অপরিবর্তিত রুটিনমাফিক চলতে হয়। অন্য ঋতুর মতো শীতেও তাদের কর্মক্ষেত্রে যেতে হয় এবং অন্য সময়ের মতো কাজ করতে হয়। যাদের কঠোর পরিশ্রম ও কাজের জন্য আমাদের দেশের উন্নতি হচ্ছে, তারা কেমনভাবে দিন অতিবাহিত করছে, তা হয়তো অনেকে ভেবেছেন। কিন্তু সরকারিভাবে যতটা ভাবা প্রয়োজন ছিল, তা হচ্ছে না। বিভিন্ন জায়গায় শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয় বটে। দেখা যায়, কোনো সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ব্যানার সাঁটিয়ে কয়েকজন অতিথি এসে শীতার্তদের মাঝে কম্বল, সোয়েটার কিংবা চাদর বিতরণ করছেন। এটা ভালো উদ্যোগ। কিছুটা হলেও শীতার্ত মানুষ স্বস্তি লাভ করে এমন গরম কাপড় পেয়ে। কিন্তু আমাদের দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠান নাচগান, কনসার্ট কিংবা অযথা আপ্যায়নের নামে যে টাকা ব্যয় করে, তার তুলনায় শীতবস্ত্র বিতরণের পরিমাণ একেবারেই নগণ্য। পার্টির নামে, ভ্রমণের নামে সরকারি-বেসরকারি অফিসে যখন ব্যয় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা, তখন আমাদের দেশের শিশু ও বৃদ্ধরা বাসি-পানতা খেয়ে হাড় কাঁপানো শীতে ঠক ঠক করে কাঁপে। অনেক শিশু শীতে স্কুলে যেতেও পারে না। বৃদ্ধরা পারে না বিছানা ছেড়ে উঠতে।

     

    সরকারিভাবে অনেক সময় শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা কিংবা সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে এগুলো এসে থাকে। আবার কখনো সরকারদলীয় নেতাদের মাধ্যমে আসে। শীতে যে কাপড় শীতার্ত গরিব মানুষ পাবে বলে ধারণা করা হয়, এক্ষেত্রে ঘটে তার উলটো। যাদের কম্বল বিতরণ করতে দেওয়া হয়, তাদের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় শীতবস্ত্র সংগ্রহ ও বিতরণের প্রতিযোগিতা। বাকি যা থাকে তাও আবার চলে যায় প্রভাবশালী নেতার আত্মীয়স্বজনের কাছে। আবার শীতবস্ত্র বিতরণে দলীয়করণও লক্ষ করা যায়। শীতবস্ত্র পাবে-এমন যোগ্য ব্যক্তিকে ফাঁকা রেখে দলীয় মানুষকে একটার পরিবর্তে তিনটা পর্যন্ত কম্বল দেওয়া হয়।

     

    যে কোনো বিপদ বা দুর্যোগ এলে আমাদের দায়িত্ব বেড়ে যায়। শীত এলেও এমন দায়িত্ববোধ নাড়া দেয়। এ সময় শীতার্তরা শুধু আমাদের দিকে চেয়ে থাকে। তাদের চেয়ে থাকা মুখে আমরা হাসি ফুটাতে পারি কেবল দুমুঠো খাবার ও শীতবস্ত্র সরবরাহের মধ্য দিয়ে। তাদের সান্ত্বনা দিতে পারি একটু সুন্দর ব্যবহার করে। মানুষ তো মানুষেরই জন্য। একজনের দুর্যোগ-দুর্ভোগে অন্যজন এগিয়ে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই আমাদেরও শীতার্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে। যেসব শিশু বা বৃদ্ধ শীতে কাঁপছে, তাদের পাশে আমরা দাঁড়াতে পারি। কেউ কম্বল কিনে আবার কেউ নিজের বাসার ব্যবহৃত কোনো গরম কাপড় দিয়েও শীতার্ত দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি। সাধ্যমতো আমরা যেন সর্বদা শীতার্ত মানুষের, বিশেষ করে শিশুদের পাশে থাকি-এটাই সবার প্রত্যাশা।

     

    শাহাদাত আনসারী : শিক্ষা গবেষক

    ansarisahadat4@gmail.com